ঢাকা | ডিসেম্বর ২২, ২০২৪ - ১১:১৬ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনামঃ

“জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রভাব ও অভিযোজন”-লেখক বাহলুল আলম

  • দৈনিক নবিন আলো প্রতিদিন
  • আপডেট: Wednesday, November 27, 2024 - 12:23 pm
  • Shobhan Hossain
  • পঠিত হয়েছে: 30 বার

মেহেদী হাসান,(রামপাল)সংবাদদাতা

আজকের পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোবাবেলা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি কোনো একক রাষ্ট্রের বা বিশেষ কোনো অঞ্চলের সমস্যা নয়, বরং একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে আজ সকলের সামনে দৃশ্যমান হয়েছে। জলবায়ুর চেনাজানা ধরণ বদলে যাওয়াকেই বলা হচ্ছে আজকের এই  জলবায়ু পরিবর্তন। এই পরিবর্তন দু’ভাবে হয়ে থাকে (১) প্রাকৃতিক ভাবে, এবং (২) মনুষ্য সৃষ্ট। প্রাকৃতিক ভাবে জলবায়ু পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যেখানে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বায়ু এবং অন্যান্য উপাদান কয়েক দশক বা তার বেশি সময় ধরে ধীরে-ধীরে সহনশীলতার মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। ৮ (আট) হাজার বছর পূর্বের সময় থেকে শিল্প-বিপ্লবের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে তাপমাত্রা মোটামুটি স্থির ছিলো; এ-সময়ের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ৫.৬ থেকে ৮.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বৃদ্ধি পেয়েছে। যা জীব-বৈচিত্রের জন্য সহনশীলতার মধ্যে ছিলো।  পাশাপাশি মনুষ্য সৃষ্ট কারনে আজকের পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান চালিকা শক্তি অনিয়ন্ত্রিত জীবাশ্ব জ্বালানির (প্রধানত-তেল, গ্যাস, কয়লা, এলএনজি) ব্যবহার বায়ু মন্ডলে তথা গ্রীণ হাউজে কার্বন-ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন, মিথেনসহ নানা ধরনের ক্ষতিকারক গ্যাস বৃদ্ধি, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মেরু অঞ্চলের বরফ বা আইচ ক্যাপ/হিমবাহ গলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি লবনাক্ততার প্রসার (বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনিস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের ফলে বিগত ৩৬ বছরে দেশে লবণাক্ত জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ ২ হাজার দশমিক ৮১ হেক্টরে)। ঝড় বন্যা জলাবদ্ধতা সাইক্লোন খরা তাপদাহ দাবানল টর্নেডো নিম্নচাপ ভুমিকম্প অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি লবনাক্ততা মরুকরণ সর্বপরি মানুষের জীবন-জীবিকার উপর ছড়ি ঘোরানোর নেতৃত্ব দিচ্ছে আজকের এই জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন; এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবী অর্ধেকেরও বেশী জীববৈচিত্র ধ্বংষ হয়ে যাবে, যা ইতোমধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে মানুষের জীবন-জীবিকার উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে, সুপেয় ও মিষ্টি পানির সংকট তিব্রতর হচ্ছে। আহত ও নিহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঘরবাড়িসহ অবকাঠামো-গাছপালা-ফসল ধংস ও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে, দারিদ্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে, স্থানাস্তরিত হচ্ছে উপকুলের বাসিন্দারা, মানুষ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে, বিশেষ করে নারী-শিশু-প্রতিবন্ধীরা অধিক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, বন্ধাত্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, পাশাপাশি বাল্যবিবাহ-বহুবিবাহ, শিশুমৃত্য, ডিভোর্স এর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রয়েছে বজ্রপাতের প্রকোপ এবং কালবৈশাখীর ছোবল। এছাড়াও অস্বাভাবিক তাপ ও শৈত্যপ্রবাহ তো আছেই। চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সেবার অবস্থাও করুন। মাস্কিপক্ষ, করোনা, হাম-রুবেলা, ডেঙ্গুসহ নতুন-নতুন রোগের আবির্ভাব ও বিকশিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে; জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তিন-চতুর্থাংশ বা ১৩ কোটির বেশি মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক নিচে নেমে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শস্যের গুণাগুণ ও উৎপাদনেও পরিবর্তন আসবে। বর্তমান চাষযোগ্য এলাকায় উৎপাদন হ্রাস পাবে। পানির স্বল্পতা বৃদ্ধি পাবে, হ্রাস পাবে মাটির উর্বরতা। একই সঙ্গে নতুন নতুন রোগবালাই দেখা দিতে পারে। ফলে কৃষিতে কীটনাশক ও সারের প্রয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি জমিতে সেচের ব্যাপকতা বাড়বে, বাড়বে ভূমিক্ষয়। আশংকার বিষয় হলো; জার্মানওয়াচ নামে একটি পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক-২০২৩ ‘ এর মতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইসিসিসিএডি)-এর তথ্য অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলের মানুষের ঘরবাড়ি ও জীবিকা বিপন্ন হওয়ার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় নয় লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে এবং বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১৯ টি জেলার ১২০ বর্গকিলোমিটার এলাকার ১২ থেকে ১৮ শতাংশ ডুবে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।  বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে আর্কটিক অঞ্চলের সমুদ্রের বরফ প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে। এই অঞ্চলে এখন গ্রীষ্মে বরফের পরিমাণ যে হারে গলে যাচ্ছে, শীতে তা পুনরায় জমে উঠছে না। বর্তমান শতাব্দীর মধ্যেই গ্রীষ্মকালে আর্কটিক সমুদ্রের বরফ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই নিষ্ঠুরতার সাথে নিজেদের অভিযোজন করতে পারবো কি? আমরা কি পারবো ক্রমবর্ধমানভাবে বৃদ্ধি পাওয়া সাইক্লোন, ঝড়, বন্যা ও খরা মোকাবিলা করতে? গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ১৮৫টি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ডলার। আমাদের জন্য কি থাকবে মাইগ্রেসনের সময়? আমরা এত দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে কিভাবে অভিযোজিত হবো? কিভাবে ঘটবে আমাদের বিবর্তন?  সবকিছু বিবেচনা করলে দেখা যায়, এমন একটা সময় আসছে যখন আমরা সাইকো হয়েও টিকে থাকার সুযোগ পাবো না! গ্লোবাল কার্বন বাজেট রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাগাদ বিশ্বে নিঃসৃত কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ পৌঁছাবে ৪১ হাজার ৬০০ কোটি টন। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর বায়ুমণ্ডলে যোগ হওয়া অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়বে ১ হাজার কোটি টন। এই বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের প্রধান কারণ তিনটি। এগুলো হলো কয়লা, জ্বালানি তেল এবং গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাপক ব্যাবহার, দাবানল এবং গাছপালা কর্তন ও বনজঙ্গল ধ্বংস করা। যদি আমরা কার্বন-ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারি, তাহলে অবধারিত ভাবেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে এবং আমাদেরকে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে। ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত কপ সম্মেলনে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্যরাষ্ট্র। সেই চুক্তির মূল শর্ত ছিল যে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সদস্যরাষ্ট্রগুলো প্রতি বছর কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমিয়ে আনবে এবং বিশ্বের তাপমাত্রা কোনোভাবেই ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। তবে বাস্তবে ঘটেছ তার বিপরীত। গত এক দশকের প্রায় প্রতি বছরই বেড়েছে নিঃসৃত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ব্যাপকমাত্রায় বনজঙ্গল ধ্বংসও এজন্য অনেকখানি দায়ী। বিশ্বে ৮০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী জি-২০ ভুক্ত (আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি,মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, ভারত, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) শিল্পোন্নত দেশগুলো। সেখানে বাংলাদেশ দায়ী মাত্র দশমিক ৪৭ শতাংশমাত্র। অথচ জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বৈশ্বিক  ঝুঁকির সুচকে আমরা ৭ম অবস্থানে। তাহলে কি আমরা এই উপকূলীয় এলাকার জনগোষ্ঠি হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকবো! নিশ্চয়ই না, আসুন, সবার মধ্যে এখন থেকেই জনসচেতনতা তৈরি করি। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (National Adaptation Plan – NAP) গ্রহণ করেছে । জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এই জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (NAP-National Adaptation Plan) চূড়ান্তকরণের কাজ চলছে, যার আওতায় আমাদের অভিযোজন খাতে ২০৫০ সালের মধ্যে ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অন্তর্জাতিক মহলের কাছে সবুজ জলবায়ু তহবিল, ক্ষয়ক্ষতির অর্থায়নের জন্য এভিডেন্স সহ দাবী তুলতে হবে। অবশ্যয়ই এই দাবি হত হবে অনুদানের ভিত্তিতে ঋণ হিসেবে নয়। সময় হয়েছে ভবিষ্যৎ বাসযোগ্য পৃথিবী বিনির্মানে প্রাণ-প্রকৃতির পাশে দাঁড়ানোর…

জলবায়ু অভিযোজন :

জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুসমূহের মধ্যে অন্যতম উদ্বেগ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপকতা পুরো বিশ্বকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মানবসভ্যতা তথা জীববৈচিত্র্যের চিরচেনা চরিত্র চ্যালেঞ্জ ও বিপর্যয়ের মূখে। বলাই বাহুল্য, জলবায়ুর পরিবর্তনে উদ্ভূত এই বিরূপ পরিবেশ ঝুঁকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষের দ্বারাই তৈরি হয়েছে। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে আমাদের অভিযোজন করতে পারাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজনের উপায় অনুসন্ধান করে নিচের আলোচনার দিকে মনোযোগ দিতে পারি।

বিভিন্ন জীব তাদের বৃদ্ধি ও বিকাশকালে বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়। অভিযোজন (Adaptation)  হলো একটি জীবের গঠন বা আচরণের পরিবর্তন যা জীবকে তার আবাসস্থলে আরও ভালভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে এবং ঐ জীবের টিকে থাকার যোগ্যতাকে বৃদ্ধি করে।  জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন (Climate Change Adaptation) হল পরিস্থিতিকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বা প্রবণতা পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান বা প্রত্যাশিত প্রভাবের সাথে তাল-মেলানোর প্রক্রিয়া। অভিযোজন মানুষের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি এড়ানোর লক্ষ্য রাখে এবং মানুষের জীবদ্দশায় হাতে নেয়া চলমান কাজ যা পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকতে সহায়তা করে। অভিযোজনের উদ্দেশ্য হলো পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বা মানিয়ে নিয়ে জীবনধারণ ও বংশবিস্তার করা। অভিযোজন বিজ্ঞান এ পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজনের তিনটি পর্যায় চিহ্নিত করেছে; প্রথম পর্যায়টি হচ্ছে।

১) জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রতিকূল প্রভাবগুলো মূল্যায়ন করা:
জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রতিকূল প্রভাবগুলো মূল্যায়ন করা (রিক্স ম্যাপিং করা) অর্থাৎ যাচাই করে দেখা যে, আমরা আসলেই এমন কিছু করছি কি-না, যা উক্ত প্রভাবগুলো আমাদেরকে আরো ঝুঁকির সম্মুখীন করে তুলছে; এবং সে অনুসারে ব্যাক্তি পর্যায়ের পাশাপাশি সরকারী বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিতে হয়। আমাদের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদেরকে (বাংলাদেশ) অবশ্যই ঝুঁকির দিক বিবেচনায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মূল্যায়ন করতে হবে এবং অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের দরিদ্র মানুষেরা সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত। কারণ, এই প্রতিকূলতাগুলো প্রতিরোধ করার মতো কোনো উপায় তাদের কাছে নেই।

২) স্বপ, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৃষি ও অবকাঠামোসমূহে বিনিয়োগ:

অভিযোজনের দ্বিতীয় পর্যায়টি হলো  স্বপ, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি  অবকাঠামোসমূহে বিনিয়োগ করার প্রবণতা তৈরি করা। বিবেচনা করতে হবে ঘরবাড়ি, সেতু-কালভার্ট, রাস্তা-ঘাট, বিমান ও নৌবন্দরগুলোর বিষয়, যাতে সেগুলো ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহিষ্ণু হয়। উল্লেখ্য যে সারা বিশ্বে সব বড় অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রতিকূল প্রভাবগুলো বিবেচনা করা হচ্ছে। এ-ধাপটির কিছু উদ্যোগ ব্যাক্তি পর্যায়ের পাশাপাশি সরকারী বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিতে হয়। যেমন–

  • আকস্মিক বন্যায় করণীয় সম্পর্কে কৃষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা; আবহাওয়ার প্রতি নজর রেখে কৃষি কাজের পরিকল্পনা করা ;
  • মৌসুমি বন্যার আগে তোলা যায় এমন ফসল যেমন আলু, ভূট্টা, চিনা বাদাম ও দ্রুত বর্ধনশীল শাক সবজি চাষ করা;
  • ন্যা সহনশীল ধান যেমন: ব্রি ধান৫১, ব্রি ধান৫২, বিনাধান-১১, বিনাধান-১২ ইত্যাদি চাষ করা;
  • খরা অঞ্চলে আগাম জাতের রোপা আমন (ব্রিধান ৩৩, ব্রিধান-৩৯ বা উপযোগী অন্যান্য জাত) চাষ করে আগাম কেটে ছোলা বা খরা সহিষ্ণু ফসল আউশ ব্রিধান ৪২, ব্রিধান ৪৩ চাষ করা
  • জলবায়ু পরিবর্তনে লবণাক্ততাপ্রবণ এলাকার কৃষি পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় লবণ সহিষ্ণু আমন ধান ব্রি–৪৭, ব্রি–৫৫, ব্রি–৬৭, বিনা–৮ ও বিনা–১০, বোরো মৌসুমে ব্রি ধান-৪৭, ব্রি ধান-৬১, আমন মৌসুমে ব্রি ধান-৪০, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান-৫৪, বিনাধান-৭ এবং বোরো ও আউশ মৌসুমে ব্রি ধান-৫৫ প্রভৃতি ও আগাম জাত ব্যবহার করা
  • বসতভিটা উঁচু করে তৈরি করে চারপাশে কলা গাছ এবং বাঁশসহ অন্যান্য গাছ লাগানো;
  • হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলে জন্যও উচু জায়গায় ব্যবস্থা রাখা; বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন বাড়ানো;
  • পুকুরের পাড় উঁচু করা, জাল দিয়ে পুকুরের চারদিক ঘিরে রাখা, ঘেরের আইলে/পুকুর পাড়ে সবজি চাষ করা;
  • বন্যার পানি নেমে যাবার সাথে সাথে বাড়ির আশপাশে রাস্তার ধারে চর এলাকায় পতিত জমিতে খেসারি, মাসকলাই, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করা;
  • বন্যাপ্রবণ এলাকার নদী ভাঙ্গন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা যেমন নতুন বাঁধ দেয়া, কিংবা পুরাতন বাঁধ মেরামত করা;
  • রাস্তাঘাট উঁচু করে তৈরি করা, এবং তা ভাঙ্গন রোধে রাস্তার পাশে উপযোগী গাছপালা (রেইনট্রি, মেহেগনি ইত্যাদি) লাগানো;
  • বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর জমিতে যথাসম্ভব আইল বেঁধে পানি নিষ্কাশন করে আগাম জোঁ আনার ব্যবস্থা করা।
  • বাঁধ রক্ষায় প্রয়াজনীয় ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে যোগাযোগ রাখা;
  • উঁচু জায়গার অভাবে কলা গাছের ভেলা বা চাটাইয়ের উপর কাদামাটির প্রলেপ দিয়ে ভাসমান বীজতলা তৈরি করে এতে বীজ বপন করে পরবর্তী সময়ের জন্য প্রস্তুত রাখা; কমিউনিটি বীজতলা তৈরি করা;
  • বন্যার সময় শুকনো জায়গার অভাব হলে টব, মাটির চাড়ি, কাঠের বাক্স, ড্রাম, ভাসমান কচুরিপানার স্তূপ বা কলার ভেলায় মাটি দিয়ে আগাম শীতকালীন সবজির চারা উৎপাদনের ব্যবস্থা নেয়া;
  • ছোট পুকুর, পারিবারিক ও যৌথ উদ্যোগে পুকুর গভীরভাবে খনন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে সম্পূরক সেচ দেয়া যায়; খাবার পানির জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষনের ব্যবস্থা করা;
  • জৈব সার তৈরি ও ব্যবহারকরে মাটির উর্বরতা এবং পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা:
  • বিকল্প উপার্জনের ব্যবস্থা রাখা;

৩) রূপান্তরমূলক অভিযোজন:

অভিযোজনের তৃতীয় পর্যায়টিকে রূপান্তরমূলক  (স্থানান্তরিত ও পরিবর্তিত) অভিযোজন বলা হয়, যা এখনো কিছুটা তাত্ত্বিক পর্যায়ে রয়েছে। এখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন উল্লেখযোগ্য নজির নেই, তবে মানুষ তার ব্যাক্তি প্রয়োজনে স্থানান্তরিত ও পরিবর্তনের উদ্যোগ নিচ্ছে। প্রতিকূল প্রভাবগুলো মূল্যায়ন পূর্বক  চরম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে বসবাসের জন্য খন্ডকালীন বা সম্পূর্ণ স্থানান্তরিত করা। কার্বন নিস্ব:রণকারি যন্ত্র-শিল্পকে সবুজায়নে উদ্যোগ নেয়া। এটি কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর ঝুঁকি মোকাবিলা নয়, বরং অভিযোজন েব্যবস্থার ভালো ফল লাভের জন্যও এটি প্রযোজ্য হতে পারে।

অভিযোজনে সরকার তথা রাষ্ট্রের করণীয়:

জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ নির্ভর জিব- জীবিকা হারিয়ে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। এতে দেশের বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। টেকসই অভিযোজন করতে হলে —

  • জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে মানুষকে সজাগ ও সচেতন করা;
  • প্রধানত জীবাশ্ম জ্বালানির (তেল গ্যাস কয়লা) ব্যবহার হ্রাস করা এবং আন্তর্জাতিক ভাবে ঐক্যের ডাক দেওয়া; বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়া
  • সৌর, বায়ু, তরঙ্গ, জোয়ার এবং ভূতাপীয় শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং সে অনুযায়ি অর্থ বরাদ্ধ করা;
  • অভিযোজনে ও জলবায়ু-বান্ধব প্রযুক্তিতে (সবুজ প্রযুক্তি) পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্ধ এবং কার‌্যকরি পদক্ষেপ গ্রহন করা;
  • দেশের মধ্যে কলকারখানায় কালো ধোঁয়া নির্গমন কমিয়ে আনাসহ আইনগত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহন; সুবজ কারখানা গড়ার উদ্যোগ যেমন নিতে হবে, তেমনি যেসব অফিস আদালত বা কলকারখানা বর্তমানে রয়েছে সেগুলোকেও সবুজ করা;
  • সিএফসি (ক্লোরোফ্লুরো কার্বন হল অ-বিষাক্ত, অদাহ্য রাসায়নিক পদার্থ যাতে কার্বন, ক্লোরিন এবং ফ্লোরিনের পরমাণু থাকে) নির্গত হয় এমন যন্ত্রপাতির ব্যবহার কমানোর উদ্যোগ নেয়া;
  • রাষ্ট্রীয় ভাবে বনভূমি ধ্বংস বন্ধ করতে হবে এবং বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন বাড়াতে হবে।
  • নবায়নযোগ্য জ্বালানির সন্ধান করতে হবে (সৌর, বায়ু, তরঙ্গ, জোয়ার এবং ভূতাপীয় শক্তি) এবং ব্যবহারে সরকলকে সম্পৃক্ত করা;
  • রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকৃতির ওপর মানুষের বিরূপ আচরণ বন্ধ করা;
  • অল্প জায়গার বহুল ব্যবহার অর্থাৎ বহুতল ভবন এবং সবুজ শিল্প কারখানা স্থাপন করা;
  • শিল্পকারখানার বর্জ্য পরিশোধন নিশ্চিত করে তা নির্দিষ্ট স্থানে জমা রাখা এবং এই বর্জ্য রিসাইকেলিং করে কীভাবে অন্য কাজে লাগানো যায় সেই পন্থা উদ্ভাবনের দিকেও নজর দেওয়া;
  • প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য এবং পলিথিনের ব্যবহার কমানো, ট্যানারি বর্জ্যের পরিশোধন নিশ্চিত করা;
  • সুন্দরবন পরিবেশকে যেমন কার্বনমুক্ত করছে একই সাথে ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবেও কাজ করছে। তাই উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভের সংরক্ষণে আরও বেশি জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া;
  • আগাম সতর্কতার ব্যবস্থা আরও জোরদার করা, সেই সাথে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোয় ক্যাটেল সেল্টার সহ নারী বান্ধব আশ্রয়কেন্দ্র বাড়ানো;
  • পাশাপাশি বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষার জন্য কৃষিজমি সংলগ্ন স্থান বা খোলামাঠে বজ্রপাত প্রতিরোধক ব্যবস্থা গড়ে তোলা;

জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ রেডিও, টেলিভিশনে সংশ্লিষ্ট প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করে মানুষকে সচেতন করা